থ্যালাসেমিয়া
রোগ কেন হয় ? এর থেকে বাঁচার
উপায় কি ? এ সম্পর্কে
বিস্তারিত জেনে নিন –
থ্যালাসেমিয়া
রোগ সম্পর্কে আমরা সবাই কম
বেশি পরিচিত। এটি মূলত একটি
বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এই রোগে
আক্রান্ত রোগীরা ছোট বয়স থেকেই
রক্তস্বল্পতায় ভুগতে থাকে। সাধারণ মানুষের তুলনায় এই রোগে আক্রান্ত
ব্যক্তিদের দেহে লোহিত রক্ত
কণিকা কম তৈরী হওয়ার
কারণে মূলত এমনটা হয়ে
থাকে। বিশেষজ্ঞ দের মতে, জিনগত
ত্রুটির কারণে মূলত এই রোগটি
হয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই এই রোগ সম্পর্কে
ঠিক মত না জানার
কারণে এই রোগ থেকে
বাঁচার উপায় খুঁজে পান
না। তাই আমাদের আজকের
আর্টিকেলটিতে এই রোগ সম্পর্কে
বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে।
এখন
আসুন আমরা থ্যালাসেমিয়া রোগ
হওয়ার কারণ এবং প্রতিকারের
উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই,
থ্যালাসেমিয়া কি ?
থ্যালাসেমিয়া
হল এক ধরনের অটোজোমাল
জিনগত রক্ত
সম্পর্কিত রোগ। এই রোগের
বাহক মূলত বংশগত মাধ্যম থেকে
আসে। এই রোগ হলে
রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণা ও লোহিত
রক্ত কণিকা উৎপাদনে বাঁধা পায়। সে জন্য
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা
অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভোগে।
থ্যালাসেমিয়া রোগ কয় ধরনের এবং কেন হয় ?
সাধারণত
থ্যালাসেমিয়া রোগ দুই ধরনের
হয়ে থাকে। একটি হল আলফা
থ্যালাসেমিয়া এবং অপরটি হল
বিটা থ্যালাসেমিয়া।
আলফা
থ্যালাসেমিয়া :
আলফা
থ্যালাসেমিয়াকে অনেক সময় থ্যালাসেমিয়া
মেজর বলা হয়ে থাকে। কারণ
এই থ্যালাসেমিয়া ৪ টি জিন
দ্বারা গঠিত হয়। এই
রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পিতা এবং মাতা
উভয়ের কাছ থেকে দুইটি
করে এই জিন পেয়ে
থাকে। সে জন্য এই
রোগের তীব্রতা ও অনেক বেশি
মারাত্নক থাকে।
আমাদের
শরীরে যখন আলফা গ্লোবিন
প্রোটিন (Alpha Globin
Protein) এর সাথে সম্পর্কিত জিন
পরিবর্তিত থাকে কিংবা অনুপস্থিত
থাকে তখন আলফা থ্যালাসেমিয়া
হয়ে থাকে।
বিটা
থ্যালাসেমিয়া :
বিটা
থ্যালাসেমিয়াকে বলা হয়ে থাকে
থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এই রোগের তীব্রতা
থ্যালাসেমিয়া মেজরের চেয়ে কিছুটা কম
মারাত্নক থাকে। বিটা থ্যালাসেমিয়া দুইটি
জিন দ্বারা গঠিত হয়। এই
রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পিতা এবং মাতা
উভয়ের কাছ থেকে একটি
করে সর্বমোট দুইটি জিন পাওয়া যায়
কিংবা যে কোন এক
জনের কাছ থেকে দুটি
জিন পায়। সে জন্য
এই রোগের তীব্রতা বেশি মারাত্নক হয়
না।
আমাদের
শরীরে যখন ত্রুটিপূর্ণ জিনগুলো
বিটা গ্লোবিন প্রোটিন (Beta Globin
Protein) উৎপন্নে বাঁধা দিবে তখন বিটা
থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কে ?
থ্যালাসেমিয়া
রোগটি মূলত বংশগত রোগ
হওয়ার কারণে পিতা এবং মাতাই
এই রোগের বাহক থাকে। এটি
কিন্তু কোন ছোঁয়াচে রোগ
নয়। আবার কোন ক্যান্সার
ও নয়। তবে বংশগত
বাহক বা পিতা এবং
মাতা যদি এই রোগের
জিন বহন করে তাহলে
তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ হওয়ার
আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে।
এই রোগ হলে আক্রান্ত
রোগী ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু বাহকের
নিজের শরীরে কোন ক্ষতি হয়
না।
থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে ?
থ্যালাসেমিয়া
রোগ হলে আপনার শরীরে
যে ধরনের উপসর্গ গুলো দেখা দিতে
পারে তা নিম্নে আলোচনা
করা হলো –
হৃৎস্পন্দন
বেড়ে যাওয়া :
থ্যালাসেমিয়া
হলে আপনার শরীরের রক্ত চলাচলে এক
ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিবে। আর
এর জন্য দেহের হরমোন
গুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা
কাজ করবে। সেই
জন্য এ সময় আপনার
হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
খাবার
খেতে অনীহা প্রকাশ করা :
এই রোগ হলে আপনার
তেমন খাবার খেতে ইচ্ছা করবে
না কিংবা এ সময় আপনার
খাবারের প্রতি এক প্রকার অনীহা
সৃষ্টি হতে পারে।
গ্রোথ
ডেভেলপমেন্টে সমস্যা হওয়া :
বাচ্চাদের
ক্ষেত্রে এই রোগ ধরা
পড়লে তাদের শরীরে রক্ত ঠিক মত
তৈরী না হওয়ার কারণে
গ্রোথ হরমোন বা বৃদ্ধি হরমোন
গুলো ঠিক মত কাজ
করতে পারে না। সেই
জন্য এ সময় তাদের
Growth Hamper বা বৃদ্ধিতে বিলম্ব দেখা দিতে পারে
অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে শিশুদের
পক্ষে ঠিক মত বেড়ে
ওঠা সম্ভব হয় না।
মাথা
ব্যথা করা :
এই রোগ হলে আপনার
শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদন
কম হবে এবং শরীর থেকে
প্রচুর পরিমানে রক্ত ক্ষরণ হবে।
সেই জন্য এ সময়
আপনার অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভোগার
চরম সম্ভাবনা রয়েছে। আর রক্তস্বল্পতায় ভুগলে
অনেক সময় মাথা ব্যথার
সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এমনকি আপনি মাথা ঘুরে
অজ্ঞান ও হয়ে পড়ার
মত সিচুয়েশনে পড়ে যেতে পারেন।
জন্ডিস
হওয়া :
থ্যালাসেমিয়া
রোগ হলে রক্তস্বল্পতার কারণে
আপনার শরীরে জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
আর জন্ডিস হলে এ সময়
আপনার ত্বকের বর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে
যেতে পারে।
ক্লান্তি
অনুভব করা :
এই রোগ হলে আপনার
দেহে যে পরিমাণ রক্তের
ঘাটতি হয় তা কখনই
পূরণ হবে না ও
ব্লিডিং এর সাথে আপনার
শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান গ্লুকোজ
সেটি বেরিয়ে যাবে। আর গ্লুকোজ লেভেল
কমে গেলে স্বাভাবিক ভাবে
এ সময় আপনার ক্লান্তি
অনুভব হতে পারে।
ঘুম
ঘুম ভাব আসা :
থ্যালাসেমিয়া
রোগ হলে এ সময়
আপনার শরীরে এক ধরনের দূর্বলতা
ভাব থাকবে। আপনি কোন কাজ
করার জন্য তেমন শক্তি
পাবেন না। আর শরীর
দূর্বল থাকার কারণে এ সময় আপনার
ঘুমের প্রবণতা কাটতে চাইবে না। অর্থাৎ এই
রোগের কারণে
আপনার ঘন ঘন ঘুম
আসতে পারে।
বুকে
ব্যথা করা :
এই রোগ হলে আপনার
হার্ট বিট বেড়ে যায়।
আর হার্ট বিট বেড়ে যাওয়ার
কারণে অনেক সময় আপনার
বুকে ব্যথার সমস্যা ও দেখা দিতে
পারে।
হাত
পা শীতল হয়ে যাওয়া
:
থ্যালাসেমিয়া
রোগ হলে আপনার শরীরে
রক্ত প্রবাহ ঠিক মত হয়
না। রক্ত আমাদের শরীরকে
উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু গায়ে
যদি রক্ত কম থাকে
তাহলে উষ্ণতা কমে যেতে থাকে।
রক্ত না থাকার কারণে
এ সময় আপনার হাত
পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার সমস্যা
দেখা দিতে পারে।
শ্বাস
গ্রহণে সমস্যা হওয়া :
এই অসুখ হলে আপনি
অল্প কাজ করলে কিংবা
আপনি যদি শুধু স্বাভাবিক
হাটা চলা করেন তাহলে
ও আপনি হাঁপিয়ে ওঠতে
পারেন। আর যার জন্য
এই সময় আপনার শ্বাস
গ্রহণ করতে সমস্যা দেখা
দিতে পারে।
পায়ে
ক্রাম্প হওয়া :
থ্যালাসেমিয়া
রোগ হলে আপনার শরীরে
রক্ত চলাচল ঠিক মত হবে
না। আর এই সময়
প্রচুর পরিমাণে ব্লিডিং হবে। আর ব্লিডিং
হলে এর সাথে আপনার
দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে
সব ভিটামিন ও খনিজ লবণ
বেরিয়ে যাবে। আর এই জন্য
আপনি যদি হাটা চলা
করতে চান তাহলে আপনি
হাঁটার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি
পাবেন না বরং এই
সময় আপনার পায়ে ক্রাম্প আরও বেশি বেড়ে
যেতে পারে।
আরও জানুন:
মানসিক রোগ কি ? মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সেরা উপায়
শীতে হাঁটুর ব্যথা নিরাময়ের ৮টি উপায়
থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে কিভাবে বাঁচবেন ?
থ্যালাসেমিয়া
রোগ হলে প্রতিকারের উপায়
গুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা
করা হলো –
অতিরিক্ত
আয়রন জাতীয় খাবার গ্রহন বন্ধ করা :
থ্যালাসেমিয়া
রোগ প্রতিকার করতে হলে আপনাকে
অতিরিক্ত আয়রন জাতীয় খাবার
গ্রহন করা থেকে বিরত
থাকতে হবে। কারণ এ
সময় আপনি যদি আয়রন
কিংবা লৌহ জাতীয় খাবার
বেশি খান তাহলে আপনার
শরীরে রক্ত বেশি উৎপাদিত
হবে এবং এতে করে
আপনার শরীরে বিভিন্ন জায়গা যেমন : হার্ট, লিভার, অগ্নাশয় প্রভৃতি জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে
যেতে পারে। এটা আপনার শরীরের
জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আর এ রকম
হলে কোন বড় ধরনের
এক্সিডেন্ট ঘটতে পারে। সে
জন্য ডাক্তার যতদিন
না পর্যন্ত আপনাকে আয়রন সমৃদ্ধ ভিটামিন
গ্রহণ করার জন্য রেকমেন্ড
করে ততদিন পর্যন্ত আপনি এই ভিটামিন
গ্রহণ করবেন না।
স্বাস্থ্যসম্মত
খাদ্য গ্রহণ করা :
এই রোগ থেকে বাঁচতে
হলে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
কারণ এই অসুখ হলে
আপনার শরীর থেকে ব্লিডিং
এর সাথে প্রচুর পরিমাণে
ভিটামিন ও খনিজ লবণ
বেরিয়ে যায়। আর সেই
জন্য এ সময় আপনার শরীর অনেক দূর্বল
হয়ে পড়তে পারে। আর
এই পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করার জন্য
সাধারণত ডাক্তাররা এ সময় আপনাকে
Folic Acid (ফলিক এসিড ) গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন। ফলিক
এসিড গ্রহণ করলে আপনার শরীরে
নতুন রক্ত কনিকা তৈরি
হবে এবং এর পাশাপাশি
আপনার এনার্জি লেভেল বজায় রাখতে ও
এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করবে। আর থ্যালাসেমিয়া রোগ
হলে দেহে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি
দেখা দেয়। সেই জন্য
আপনি এ সময় ফলিক
এসিড গ্রহণের পাশাপাশি দেহের হাড় সুরক্ষিত রাখার
জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম
সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করবেন। সেই জন্য এ
সময় যেসব খাবারে পুষ্টিগুণ
বেশি থাকে ঐ সকল
খাদ্য গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছ থেকে একটি
Balance Diet এর চার্ট বানিয়ে নিতে পারেন।
নিজেকে
সব সময় পরিষ্কার পরিছন্ন
রাখা :
থ্যালাসেমিয়া
রোগ প্রতিকার করতে হলে সব
সময় নিজেকে পরিষ্কার পটিছন্ন রাখবেন। কারণ এই রোগে
প্রচুর ব্লিডিং হয়। আর ব্লিডিং
এর জায়গা গুলো যদি ঠিক
মত পরিষ্কার করা না হয়
তাহলে ঐ সব স্থানে
ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।
যা পরবর্তীতে আপনার জন্য সমস্যা সৃষ্টি
করতে পারে। তাই এই রোগ
হলে সব সময় নিজেকে
পরিষ্কার পরিছন্ন রাখবেন এবং নিরাপদ
রাখার জন্য সব সময়
সাবান দ্বারা হাত পরিষ্কার করুন।
এতে করে আপনার হাতের
ময়লা ব্লিডিং এর জায়গা গুলোতে
যেতে পারবে না। আর জ্বর
সর্দি বা ছোঁয়াচে অসুখ
হয়েছে এমন অসুস্থ মানুষের
কাছ থেকে নিজেকে দূরে
রাখবেন।
গর্ভধারণের
আগে টেস্ট করা :
আপনার
বংশের কারও যদি আগে
থেকে এই রোগ আছে
এমন কোন হিস্ট্রি থেকে
থাকে তাহলে গর্ভধারণের আগে অবশ্যই আপনি
ব্লাড টেস্ট করে নিবেন। স্বামী
স্ত্রী দুজনের রক্ত পরীক্ষা এবং
ফ্যামিলি জেনেটিক পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে জানা
যাবে ২ জনের মধ্যে
কেউ থ্যালাসেমিয়ার শিকার হয়েছেন কি না বা
ক্যারিয়ার কিনা।
বিয়ের
আগে ব্লাড টেস্ট করা :
এই ব্যবস্থা আমাদের সমাজে এখনও চালু হয় নি। তবুও নিজেদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করে হলে ও আমাদের উচিত বিয়ের আগে হবু বর এবং বউয়ের রক্ত পরীক্ষা করে নিয়া।
আমাদের পড়ামর্শ :
থ্যালাসেমিয়া
হল একটি জটিল রোগ।
এই রোগ থেকে পুরোপুরি
নিরাময় পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি
যদি সচেতন হয়ে উপরিউক্ত নির্দেশনা
গুলো ঠিক মত অনুসরণ
করতে পারেন তাহলে আপনি ও সুস্থ
এবং স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে
পারবেন।