জেনে নিন-ইউরিন ইনফেকশনের কারণ ও করণীয় বিস্তারিত
কি কারণে আপনার প্রসাব ইনফেকশন হতে পারে ? ঘরোয়া উপায়ের মাধ্যমে কিভাবে আপনি প্রসাব ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে পারবেন ? এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন –
প্রসাব ইনফেকশন কী ?
প্রসাব ইনফেকশনকে অনেক সময় আমরা ইংরেজিতে Urine Infection ও বলে থাকি। মানবদেহের মূত্রতন্ত্রের ৪ টি অংশ রয়েছে। সে গুলো হল – কিডনি, ইউরেটার, মুত্রথলি এবং মূত্রনালি। এই ৪ টি অংশের যে কোন অংশে যদি জীবাণুর দ্বারা সংক্রমিত হয় তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে ইউরিন ইনফেকশন বা Urinary Tract Infection সংক্ষেপে UTI বলা হয়।
প্রসাব ইনফেকশন কাদের বেশি হয়ে থাকে ?
ইউরিন ইনফেকশন নারী ও পুরুষ সবারই হতে পারে। কিন্তু নারীদের মধ্যে এই ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি লক্ষ করা গেছে। নারীদের মূত্রনালী পায়ুপথের খুব কাছাকাছি থাকার কারণে সেখানে জীবাণু প্রবেশ করার ঝুঁকি বেশি থাকে। আর জীবাণু প্রবেশ করলে সেই স্থানে ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
কী কারণে আপনার প্রসাব ইনফেকশন হতে পারে ?
প্রসাব ইনফেকশন হওয়ার কয়েকটি উল্লেখ যোগ্য কারণ রয়েছে। কারণ গুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে :
দীর্ঘ দিন ধরে যদি আপনি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগতে থাকেন তাহলে আপনার ইউরিন ইনফেকশনের হওয়ার ঝুঁকি মারাত্মক ভাবে বেড়ে যেতে পারে ।
পড়ুন:কোষ্ঠকাঠিন্য কি এবং কেন হয় ?সারানোর ঘরোয়া উপায়
মূত্রনালিতে জীবাণুর সংক্রমণ হলে :
মলত্যাগ করার সময় যদি পায়ুপথ থেকে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু মূত্রনালীতে প্রবেশ করলে তাহলে আপনার UTI হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করলে :
মলত্যাগ করার পর যদি আপনি পায়ু পথের পেছন থেকে সামনের দিকে টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করেন কিংবা আপনি প্রসাবের পর যোনীপথের ভেজা স্থান মোছার জন্য যদি টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করেন তাহলে ঐ টিস্যুর সংস্পর্শে সাথে থাকা ব্যাকটেরিয়া গুলো আপনার মূত্রথলুতে প্রবেশ করতে পারে। যার ফলে আপনার প্রস্রাব ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে :
আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি অনেক কম থাকে অর্থাৎ শরীরে যদি সহজে রোগ বালাই আক্রমণ করে অর্থাৎ ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
জটিল রোগে আক্রান্ত থাকলে :
আপনি যদি জটিল রোগ যেমন : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার প্রভৃতিতে আক্রান্ত থাকেন এবং এর জন্য যদি আপনি ওষুধ খান তাহলে এসব ওষুধের সাইড ইফেক্টের কারণে ও আপনার UTI হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে ।
কম পানি পান করলে :
আপনি যদি পানি কম পরিমাণে পান করেন তাহলে আপনার শরীর কড়া হয়ে যাবে এবং ইউরিন আউটপুট কম হবে। যার জন্য আপনার মূত্রনালীতে ব্যাকটেরিয়া জমতে পারে এবং পরবর্তীতে এটি ইউরিন ইনফেকশন পরিণত হতে পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে প্রসাব আটকে রাখলে :
দীর্ঘ সময় ধরে যদি আপনি প্রস্রাব আটকে রাখেন তাহলে মূত্রনালীতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যাবে যা আপনার UTI হওয়ার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যৌন মিলন করলে :
যৌন মিলনের সময় যদি আপনি স্বাস্থ্যবিধি বা সুরক্ষাবিধি মেনে না চলেন তাহলে আপনার মূত্রাশয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে ইউরিন ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে।
হাই কমোড ব্যবহার করলে :
ডাক্তারের মতে, যারা হাই কমোড ব্যবহার করেন তাদের UTI হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ আপনি যখন কমোডে বসেন তখন এতে লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে চলে আসতে পারে।যার জন্য ও আপনার ইউরিনারি ইনফেকশন হতে পারে।
টাইট পোশাক পরিধান করলে :
আপনি টাইট জিন্স বা প্যান্ট পরিধান করেন তাহলে আপনার ইউরেথ্রার চারপাশে ঘাম হতে পারে আর এই ঘাম থেকে আসা ব্যাকটেরিয়ার জন্য ও প্রস্রাব ইনফেকশন ঘটতে পারে।
সঠিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করলে :
পিরিয়ডের সময় যদি আপনি সঠিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে না পারেন তাহলে পিরিয়ডের দূষিত রক্ত আপনার মূত্রপথে এসে UTI হওয়ার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে :
আপনার প্রস্টেট গ্রন্থি যদি বড় হয়ে যায় ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। আবার যদি মূত্রথলিতে পাথর হয় তার জন্য ও অনেক সময় ইউরিনারি ইনফেকশন হতে পারে।
প্রসাব ইনফেকশন হলে যে সব উপসর্গ দেখা দিতে পারে ?
প্রসাব ইনফেকশন হলে আপনার শরীরে যে ধরনের উপসর্গ গুলো দেখা দিতে পারে তা নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
মূত্রনালীতে জ্বালা-পোড়া করা :
ইউরিন ইনফেকশন এর অন্যতম লক্ষণ হল মূত্রনালিতে জ্বালা-পোড়া করা। এই ইনফেকশন হলে প্রসাব করার সময় আপনার মূথনালীতে জ্বালা-পোড়া কিংবা ব্যথা হবে।
প্রসাবের সময় ব্যথা করা :
এই ঘা বা ইনফেকশনের কারণে প্রস্রাব করার সময় আপনার প্রস্রাবের রাস্তায় ব্যথা হবে।
তলপেটে ব্যথা করা :
UTI এর কারণে প্রস্রাব করার সময় আপনার তলপেট জুড়ে ব্যথা হবে।
ঘন ঘন প্রসাব হওয়া :
আপনার যদি ইউরিন ইনফেকশন হয় তাহলে কিছুক্ষণ পরপর প্রস্রাবের বেগ আসতে পারে এবং এ সময় আপনার প্রস্রাব করার পরও আবার হবে এমনটা মনে হতে পারে।
প্রসাবে দুর্গন্ধ হওয়া :
UTI হলে আপনার প্রসাবে অস্বাভাবিক দুর্গন্ধ ভাব হতে পারে।
প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন হওয়া :
ইউরিন ইনফেকশন এর কারণে আপনার প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন হয়ে গাঢ় হলুদ বা বাদামী বর্ণের দেখা দিতে পারে।
গায়ে জ্বর আসা :
প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে আপনার গায়ে জ্বর জ্বর ভাব বা জ্বর হতে পারে। ইনফেকশন এর মাত্রা বেশি হলে এ সময় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।
বমি হওয়া :
UTI এর কারণে আপনার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে। এ জন্য এ সময় আপনার বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
ক্লান্তি অনুভব করা :
ইউরিনারি ইনফেকশন হলে সাধারণত খাওয়ার রুচি কমে যায়। না খাওয়ার জন্য আপনার ক্লান্ত বা দুর্বল অনুভূত হতে পারে ।
প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে করণীয় ?
প্রস্রাব ইনফেকশন হলে কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করতে পারেন সে সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
বেশি করে পানি পান করা :
ইউরিনারি ইনফেকশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পানির বিকল্প কিছুই নেই। সে জন্য আপনাকে বেশি করে পানি পান করতে হবে। এতে করে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়বে। এর ফলে জীবাণু আপনার শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে যাবে। তাই UTI থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনাকে দিনে অন্তত ৩-৪ লিটার পানি পান করতে হবে।
পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকা :
Urine Infection প্রতিরোধ করতে হলে সব সময় আপনাকে পরিষ্কার-পরিছ্ন্নতা বজায় রাখতে হবে। এ জন্য নিয়মিত গোসল করতে হবে। আর কুসুম গরম পানিতে গোসল করার চেষ্টা করবেন। এতে করে ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে এক স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা যাবে না। চেঞ্জ করে ফেলতে হবে।
প্রস্রাব আটকে রাখা যাবে না :
প্রস্রাব ইনফেকশন হওয়া ঠেকাতে হলে কখনই প্রস্রাব আটকে রাখা যাবে না। অর্থাৎ প্রস্রাব আসার সাথেই অন্য কাজ করা বাদ দিয়ে আগে প্রস্রাব করে নিবেন।
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা :
ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে হলে আপনাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ই, সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। ভিটামিন সি আপনার শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ছাড়াও মূত্রথলীকে ভালো রাখতে ও প্রস্রাবের সময় জ্বালা ভাব কমাতে সহায়তা করবে। তাই আপনাকে টক ফল, আনারস, আমড়া, পেয়ারা, শসা, সবুজ শাকসবজি প্রভৃতি বেশি করে খেতে হবে।
পরিষ্কার পানি ব্যবহার করা :
বারবার UTI হওয়া থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে অপরিষ্কার পানি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাই গোসলের সময় বা প্রস্রাবের পর পরিষ্কার পানি ব্যবহার করবেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে যৌন মিলন করা :
যৌন মিলন করার আগে ও পরে প্রস্রাব করে নিবেন। এতে করে আপনার মূত্রনালীতে জীবাণু প্রবেশের আশঙ্কা কম থাকবে এবং ইউরিনারি ইনফেকশন রোধ হবে।
ঢিলেঢালা কাপড় পরিধান করা :
আর সব সময় ঢিলেঢালা সুতির কাপড় পরিধান করার চেষ্টা করবেন এতে করে আপনার ইউরেথ্রার আশপাশের জায়গা গুলো ঘামবে না। এর ফলে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটবে না এবং UTI হওয়ার ঝুঁকি কম থাকবে।
জটিল রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা :
আপনি যদি জটিল রোগ যেমন : উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস প্রভৃতিতে আক্রান্ত থাকেন তাহলে অবশ্যই সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবেন। এতে করে আপনার ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
প্রয়োজনে পড়ুন:
নিয়মিত যে সব ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস থাকবে নিয়ন্ত্রণে
সর্তকতার সাথে টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করা :
টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করবেন যেন টিস্যুর অংশ প্রস্রাবের রাস্তায় চলে না যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে,
Urine Infection একটি জটিল সমস্যা। এই রোগ হলে আমাদের দেহে খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইউরিনারি ইনফেকশন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত রোগ হওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্যায় ভুগলে, ইনফেকশন কিডনিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার ফলে শরীরে নানা ধরনের জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে জন্য প্রস্রাব ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে আমাদের শীঘ্রই চিকিৎসক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করালে এই রোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে। তাই প্রস্রাব ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে উপরিউক্ত বিষয় গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং সময় থাকতে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।