যাত্রা পথে বমি ! কেন হয় এবং হলে কি করবেন ? এ সম্পর্কে জানতে হলে লেখাটি বিস্তারিত পড়ুন –
যাত্রা
পথে বমি খুবই কমন
একটি সমস্যা। আমাদের মধ্যে অনেকেই যানবাহনে উঠলে মাথা ঘোরা,
বমির সমস্যার সম্মুখীন হই। একে চিকিৎসা
বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Motion Sickness (মোশন সিকনেস)। আর এই
সমস্যা যার হয় সেই
একমাত্র টের পায় যে
এটা কতটা অস্বস্তিকর। তবে
আমরা যদি নির্দিষ্ট কিছু
বিষয় খেয়াল করতে পারি এবং
সেই সাথে কিছু নিয়ম
মেনে চলতে পারি তাহলে
সহজেই এই সমস্যা থেকে
মুক্তি পেতে পারব। কিন্তু
আমরা এই বিষয় গুলো
সম্পর্কেই আমরা অনেকেই ঠিক
মত জানি না। যার
ফলে অধিকাংশ মানুষই যানবাহনে উঠলে ভমেটিং এড়াতে
পারে না। তাই যাত্রা
পথে বমি রোধ করার
জন্য আমাদেরকে মোশন সিকনেস হওয়ার
কারণ এবং প্রতিরোধের উপায়
সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা উচিত।
এখন
চলুন আমরা যাত্রা পথে
বমি হওয়ার কারণ এবং কিভাবে
এটা রোধ করব সে
সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই,
যাত্রা পথে বমি হওয়ার কারণ গুলো কি কি ?
কিছু
নির্দিষ্ট কারণে আপনার যাত্রা পথে বমি হতে
পারে। কারণ গুলো সম্পর্কে
নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
ভ্রমণ
গতি ও জড়তার কারণে
:
মোশন
সিকনেস মূলত ভ্রমণের সময়
সৃষ্ট গতি ও জড়তার
কারণে হয়ে থাকে। যানবাহনে
উঠার পরে ভ্রমণগত গতি
ও জড়তার কারণে আামাদের মস্তিষ্কে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়! আর এই
সমন্বয়হীনতার জন্য দায়ী হল
আপনার অন্তঃকর্ণ এবং চোখ।
* একটা
উদাহরণ দিয়ে বুঝা যাক,
আপনি যখন বাসের চড়েন
তখন এর ঝাঁকুনিতে আপনার
কানের ভেতরের ফ্লুইড নড়াচড়া করতে থাকে। এ
সময় আপনার অন্তঃকর্ণ ব্রেইনকে খবর পাঠায় যে
আপনার শরীর গতিশীল অবস্থায়
আছে। কিন্তু আপনি বাস্তবে চোখ
দিয়ে দেখছেন যে আপনার শরীর
ও আশেপাশের মানুষ গুলো স্থির অবস্থায়
আছে।
* এ
জন্য আপনার চোখ আবার ব্রেইনকে
ইনফরমেশন পাঠায় যে বডি স্থির
অবস্থায় আছে। এই দুই
রকম তথ্যের জন্য মস্তিষ্কে একটি
সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়। আর এ
রকম সিচুয়েশনকে আপনার মস্তিষ্ক
বিষ হিসেবে শনাক্ত করে। তাই তখন
সে এই
বিষ আপনার বডি থেকে বের
করে দেয়ার জন্য অন্তঃকর্ণে সংকেত
পাঠায়। এর ফলে শরীর
ভারসাম্যহীন হয়ে
পড়ে। যার জন্য যাত্রা
পথে আপনার বমি বা বমি
বমি ভাব হতে পারে।
এ্যাসিডিটির
সমস্যা থাকলে :
আপনার
যদি এ্যাসিডিটি বা বদ হজমের
সমস্যা থাকে তাহলে যানবাহনে
উঠার পরে এর অতিরিক্ত
ঝাঁকুনির কারণে হজম না হওয়া
খাদ্যবস্তু উপরের দিকে উঠে আসে
তথা গলবিলের কাছাকাছি চলে আসে। বাসের
ঝাঁকুনি ও অতিরিক্ত গতির
কারণে তখন আপনার খাদ্যনালীতে
হজম না হওয়া খাদ্যবস্তু
গুলো বমির মাধ্যমে শরীর
থেকে বের হয়ে যায়।
ধূমপান
করলে :
আপনি
যদি যাত্রা পথে ধূমপান করেন
বা ঐ বাসে কোন
ধূমপায়ী ব্যক্তির কাছাকাছি সিটে বসেন তখন
ঐ সিগারেটের ধোঁয়াতে থাকা বিষাক্ত পদার্থ
আপনার নাকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। আর বিষাক্ত
ধোঁয়া দেহের ভিতরে গেলে এটা আপনার
ফুসফুসকে বিষিয়ে তুলবে আর তখন এই
বিষ দেহ থেকে বের
করে দেয়ার জন্য আপনার বমি
হবে।
মাইগ্রেইনের
সমস্যা থাকলে :
আপনার
যদি মাইগ্রেইনের সমস্যা থাকে তাহলে ভ্রমণের
সময় অতিরিক্ত ঝাঁকুনি ও গতির কারণে
এই ব্যথা আরও বেশি বেড়ে
যাবে। তখন এ সময়
দেহে অস্বস্তি কাজ করে এবং
আপনার মাথা ঘুরতেছে এমন
বোধ হতে পারে। যার
ফলে এ সময় আপনার
মোশন সিকনেস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
অসুস্থতার
কারণে :
শরীর
অসুস্থ থাকা অবস্থায় যদি
আপনি ভ্রমণ করেন তখন বাসের
অতিরিক্ত গতি ও ঝাঁকুনিতে
আপনার শরীর আরও বেশি
অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
এর ফলে ও ভ্রমণরত
অবস্থায় আপনার বমি বমি ভাব
বা বমি হতে পারে।
যানবাহন থেকে নির্গত বাজে দুর্গন্ধের কারণে :
যানবাহন
থেকে যে কালো ধোঁয়া
বের হয় তাতে অকটেন, প্রভৃতি
ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাস মিশ্রিত থাকে। যা আমাদের শরীরের
জন্য এক ধরনের বিষ।
আর এই বিষাক্ত ধোঁয়া
যখন নাক দিয়ে আপনার
শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে তখন শরীরে
ভিতরে এন্টিবডি গুলো এর বিরুদ্ধে
এক প্রকার ইমিউনো রেসপন্স দেয় যার জন্য
এই বিষাক্ত ধোঁয়া বমির মাধ্যমে আপনার
শরীর থেকে বের হয়ে
যাবে।
বাসে
পেছন দিক ফিরে বসলে
:
আপনি যদি বাসের উল্টো দিকে অর্থাৎ যেদিক বাস চলছে সেদিক পেছন ফিরে বসেন তাহলে যখন বাস ব্রেক কষবে তখন সঙ্গে সঙ্গে আপনি পেছনের দিকে হেলে পড়বেন। এ সময় আপনার মাথা ঘুরে মোশন সিকনেস হতে পারে।
যাত্রাপথে বমি থেকে মুক্তি পেতে করণীয় ?
কিছু
সহজ উপায় অনুসরণ করতে
পারলে আপনি যানবাহনে চড়ার
সময়ে হওয়া বমি এড়াতে
পারবেন। উপায় গুলো সম্পর্কে
নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো -
দুশ্চিন্তামুক্ত
থাকুন :
যাত্রা
পথে বমি রোধ করতে
হলে আপনাকে গাড়িতে উঠার আগে সবার
প্রথম যে কাজটি করতে
হবে সেটা হল দুশ্চিন্তামুক্ত
থাকতে হবে। অর্থাৎ গাড়িতে
উঠলে বমি হবে এমন
মনোভাব থাকা যাবে না।
কারণ বমির চিন্তা করলেই
বমি হবে। তাই এ
সময় বমির কথা ভুলে
নিজেকে টেনশনমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। ভাল না লাগলে
গান শুনুন বা চোখ বন্ধ
রাখতে পারেন।
জানালার
পাশে বসুন :
যানবাহনে
বসার সময় সব সময়
চেষ্টা করবেন জানালার পাশে বসার। এতে
করে জানলা বাইরের বাতাস আপনার শরীরের ভিতরে প্রবেশ করবে। এতে করে বাসের
ভেতরে যে আপনার একটা
দম বন্ধ ভাব কাজ
করে সেটা কেটে যাবে।
জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য
দেখার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার
মন প্রফুল্ল থাকবে। আর মন প্রফুল্ল
রাখতে পারলে আমরা শরীর থেকে
বমি বমি ভাব কেটে
যাবে।
গাড়ির
সামনের দিকে বসুন :
যানবাহনে
উঠার সময় সামনের দিকে
বসার চেষ্টা করবেন। এতে করে আপনার
বডি পেছন দিকের তুলনায়
অপেক্ষাকৃত কম গতিশীল মনে
হবে। এতে করে আপনার
বমি বমি ভাব কম
আসবে।
ঘুমিয়ে
পড়ুন :
ভ্রমণের
সময় ঘুমিয়ে থাকার চেষ্টা করবেন। ঘুম পড়লে শরীর
অসুস্থ লাগবে না। যার ফলে
আপনার বমি হবে না।
বই পুস্তক ও মোবাইল ফোন
দেখা থেকে বিরত থাকা
:
মোশন
সিকনেসের সমস্যা থাকলে যানবাহনে চলন্ত অবস্থায় কখনই মোবাইল ফোন
দেখবেন না ও বই
পড়বেন না। এ সময়
যদি আপনি নিচু হয়ে
বই, মোবাইল প্রভৃতি দেখেন তাহলে আপনার মাথা ঘুরে বমি
আসতে পারে। তাই গাড়ি চলন্ত
অবস্থায় মোবাইল ফোন, বই পুস্তক
প্রভৃতি ব্যবহার করা থেকে বিরত
থাকুন।
যানবাহনে
বমি করছে এমন ব্যক্তির
দিকে মনোযোগ দিবেন না :
মোশন
সিকনেসের সমস্যা থাকলে, তার থেকে মুক্তি
পেতে হলে আপনাকে গাড়িতে
যদি অন্য কোন যাত্রীর
বমি হয় তাহল সেদিকে
মনোযোগ দেয়া যাবে না।
তাহলে আপনার যাত্রা পথে বমি হওয়ার
ঝুঁকি কম থাকবে।
যাত্রা পথে কি খাবার খেলে বমি হবে না ?
যে ধরনের খাবার খেলে আপনি যাত্রা
পথে বমির হাত থেকে
রক্ষা পেতে পারেন সে
খাবার গুলো সম্পর্কে নিচে
বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
আদা
:
যাত্রা
পথে বমি রোধে আদা
খুবই কার্যকরী একটি উপাদান। যাত্রা
পথে খাদ্যবস্তু ঠিক মত হজম
না হলে গ্যাসে চাপ
দেয় তখনই বমি হয়।
সে জন্য ভ্রমণের সময়
আপনি যদি আদা খান
তাহলে এটি আপনার হজম
শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
যাত্রা পথে বমি এড়াতে
আপনি আদা কুঁচি চিবুতে
পারেন, কিংবা চা এর সাথে
আদা মিশিয়ে আদা চা খেতে
পারেন। এতে করে আপনার
বমি বমি ভাব কেটে
যাবে।
লবঙ্গ
:
মোশন
সিকনেস দূর করতে লবঙ্গ
অনেক ভাল কাজ দেয়।
এ জন্য আপনি বাসে
উঠার আগেই ১-২
টি লবঙ্গ মুখের ভেতরে চিবোতে থাকবেন। এতে করে আপনার
মুখের ভেতরে যানবাহনের বাজে দুর্গন্ধ আসে
তা দূর হয়ে যাবে
এবং এর সাথে বমি
বমি ভাব ও কেটে
যাবে।
জিরা :
ভ্রমণ
পথে হওয়া বমি এড়াতে
আরেকটি উপকারী উপাদানের নাম হল জিরা।
জিরার পানি খেলে
এটি আপনার শরীরের ভিতরকার গ্যাসের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি
বমি বমি ভাব ও
নিমিষে দূর করে দিবে।
সে জন্য যাত্রা পথে
বমি রোধ করতে হলে
বাড়ি থেকে কিছু পরিমাণ
জিরা গুঁড়ো করে নিন তারপর
বাসে উঠলে যখন বমি
বমি বোধ হবে ঐ
গুঁড়া পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে
ফেলুন। দেখবেন ম্যাজিকের মত আপনার বমি
বমি ভাব দূর হয়ে
যাবে।
দারুচিনি
:
মোশন
সিকনেস দূর করতে দারুচিনি
একটি উপকারী খাবার। এটি খাবার আপনার
হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
এতে করে আপনার বদ
হজমের সমস্যা থাকলে সেটি সেরে যাবে।
এর ফলে আপনার বমি
আসবে না।
ভিটামিন
সি সমৃদ্ধ ফল :
ভিটামিন
সি সমৃদ্ধ ফল যেমন : লেবু,
আমলকি, কমলা লেবু প্রভৃতি
যাত্রা পথে বমি বমি
ভাব দূর করতে খুবই
কার্যকরী। যানবাহনে বমি বমি ভাব
আসলে তখন মুখে এক
টুকরো লেবু নিয়ে চুষতে
থাকেন। কিংবা এক গ্লাস পানিতে
এক টুকরো লেবু নিয়ে তার
রস পানির মধ্যে দিয়ে এবং এর
হালকা চিনি মিশিয়ে পান
করুন। এতে করে আপনার
শরীর থেকে অতিরিক্ত তাপ
কমে যাবে এবং বমির
ভাব কেটে যাবে। শরীর
ঠান্ডা থাকবে। তবে আপনার যদি
গ্যাসের সমস্যা থাকে তাহলে লেবুর
বদলে আমলকী খেতে পারেন।
পুদিনা
পাতা :
আপনার
যদি এ্যাসিডিটির সমস্যা থাকে তাহলে ভ্রমণের
সময় যখন বমি বমি
ভাব আসবে তখন পুদিনা
পাতা দিয়ে চা বানিয়ে
খেতে পারেন। এর ঘ্রাণে দেহের
ভিতরের অস্বস্তিতা কমে গিয়ে আপনার
বমি হওয়া রোধ করবে।
হাত-মুখ ধুয়ে ফেলা
:
আপনি
যদি দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করেন
তাহলে যখন যাত্রা বিরতি
দিবে তখন বাইরে গিয়ে
হাত-মুখ ধুয়ে ফেলুন।
এতে করে বাসের ধোঁয়া
থেকে আসা বাজে দুর্গন্ধ
আপনার হাত-মুখ চলে
যাবে এবং একটা ফ্রেশ
ফ্রেশ ভাব অনুভূত হবে।
হালকা
নাস্তা করে গাড়িতে উঠা
:
আর বমি হবে এই
ভয়ে কখনই খালি পেটে
ভ্রমণ করবেন না। না খেয়ে
বাসে উঠলে আপনার শরীরে
গ্যাস হতে পারে। তখন
ঐ গ্যাসের কারণে আপনার বমি হতে পারে।
তাই যানবাহনে উঠার অন্তত আধা
ঘন্টা আগে কিছু হসলজা
নাস্তা করে তারপর বাসে
উঠবেন।
আবার
ভ্রমণের আগে ভারী কিছু
খেতে যাবেন না। কারণ এতে
আপনার হজমে সমস্যা হতে
পারে।
আমাদের পড়ামর্শ :
ভ্রমণের
সময় যানবাহনে উঠলে বমি হবে
এমন মনোভাব নিয়ে কখনও যানবাহনে
উঠবেন না। কারণ এতে
আপনার সমস্যা বেশি হবে। সব
সময় নিজের মনকে আস্থা দিবেন
যে বমি হবে না।
আর বমি এড়াতে উপরিউক্ত
বিষয় গুলো ঠিক মত
অনুসরণ করার চেষ্টা করুন
তাহলে খুব সহজেই এই
সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।