আপনার বাচ্চাকে কোন কোন টিকা দিতে হবে ? কখন এবং কিসের জন্য টিকা দিতে হবে ? এ সম্পর্কে বিস্তারিত এই লেখাটি থেকে জেনে নিন । আজকের এই পোস্টটিতে আমরা এই বিষয়ে বিস্তাতির আলোচনা করবো।
সাধারণত নবজাতক শিশুর শরীর খুবই সেন্সিটিভ হয়ে থাকে। এ জন্য তার যত্ন-আত্নির একটু ত্রুটি হলেই সঙ্গে সঙ্গে তার অসুখ বিসুখ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। তাই শিশুর জন্মের পর সবার প্রথমেই তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাচ্চা জন্মের পর তাকে বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হয়।
শিশুর জন্মের পর একটা নির্দিষ্ট সময়েই তাকে টিকা দিতে হবে। আার জেনে বুঝে ভ্যাকসিন দিতে হবে। কারণ ভুল সময়ে বাচ্চাকে ভ্যাকসিন দিলে তার শরীরের ক্ষতি হতে পারে। তবে কখন কোন টিকা দিতে হবে, কখন টিকা দেওয়া যাবে না, কোথায় দিতে হবে, কোন কারণে যদি তারিখ পার হয়ে যায় তাহলে কী করতে হবে এ সব বিষয় সম্পর্কে অনেক পিতা-মাতাই ঠিক মত জানেন না। সে জন্য তারা এ সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। তাই শিশুকে বাচ্চাকে কখন, কিসের টিকা দিতে হবে টিকা সংক্রান্ত এই বিষয় গুলো সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা খুবই জরুরি।
এখন চলুন আমরা বাচ্চার টিকা সংক্রান্ত এই বিষয় গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই,
Vaccine বা টিকা কি ?
বাচ্চাকে Vaccine দেয়ার আগে অবশ্যই আমাদেরকে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে হবে। Vaccine বা টিকা হল এক ধরনের প্রতিষেধক যা শিশুকে জন্মের পরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেয়া হয়ে থাকে। প্রতিটি রোগের জন্য একটা ভ্যাকসিন বা টিকা নির্দিষ্ট থাকে। ভ্যাকসিন দেয়ার ফলে যদি পরবর্তীতে শিশুর শরীরে যদি কোন রোগের জীবাণু প্রবেশ করে তাহলে ঐ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এন্টিবডি তৈরী হয়। এই এন্টিবডি তৈরি হওয়ার কারণে বাচ্চার অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলক ভাবে কম যাবে। তাই এই সব ভ্যাকসিন আপনার বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাচ্চাকে কোন টিকা কখন দিবেন ?
শিশুর জন্মের পরে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন গুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
১. বিসিজি টিকা :
বিসিজি শব্দের অর্থ হল Bacillus Calmette–Guerin (BCG)। এই টিকা মারণ ঘাতি যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক। বিসিজি ভ্যাকসিন দিলে এটি আপনার শিশুকে ফুসফুসে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু : টিউবারকুলার মেনিনজাইটিস এবং ডিসসেমিনেটেড টিউবারকুলোসিস ছড়িয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করবে।
Dose :বিসিজি টিকার শুধু মাত্র একটাই ডোজ থাকে।
কখন দিতে হবে :
আপনার শিশু জন্মের সময় বা জন্মের পরে প্রথম ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই টিকা দিতে হবে।
কোথায় দিতে হবে :
এই ভ্যাকসিন বাম হাতের কাঁধের কাছের হাতের অংশে দেয়া হয়। ভ্যাকসিন দেয়ার ফলে শিশুর হাত হালকা ফুলে যেতে পারে। তবে আস্তে আস্তে কমে যাবে।
আরও পড়ুন: নবজাতকের যত্নের কি কি ভুল আপনার করা উচিত নয়?
২. পোলিও টিকা :
পোলিও একটি মারাত্মক রোগ। এটি জন্মের পরপর শিশুর শরীরে প্রভাব বিস্তার করে। এই রোগের টিকা দুই ভাবে দেয়া হয়। একটি হল ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন বা ‘ও.পি.ভি’ এবং আরেকটি হল ইনএফেক্টিভ পোলিও ভ্যাকসিন বা আই.পি.ভি। এই আপনার শিশুর পোলিওমাইটিস হওয়া রোধ করবে।
Dose :
পোলিও টিকার মোট ৫ টা ডোজ থাকে।
কখন দিতে হবে :
আপনার বাচ্চার জন্মের পরপরই বাচ্চাকে প্রথম ডোজ বা জিরো ডোজ দিয়ে নিতে হবে। বাচ্চা জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় সপ্তাহ হলে তাকে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। এরপর বাকি দুই ডোজ জন্মের পরের ১০,১৪ সপ্তাহ হলে প্রয়োগ করতে হবে। আর শেষে বুস্টার ডোজ জন্মের পরে ১৬-২৪ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
কিভাবে দিতে হবে :
ও.পি.ভি বাচ্চাকে মুখে খাওয়ানোর মাধ্যমে দেয়া হয়। এটি দুই ফোঁটা করে দেয়া হয়। আর আই.পি.ভি ইনজেকশন এর মাধ্যমে বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করানো হয়।
৩.হেপাটাইটিস বি টিকা :
হেপাটাইটিস বি হল একটি মারাত্মক ভাইরাস জনিত রোগ। যা আমাদের যকৃত বা লিভারকে আক্রমণ করে। এর ফলে শিশুর জন্ডিস ধরা পড়ে। হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দেয়ার ফলে আপনার শিশু ‘হেপাটাইটিস বি’ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।
Dose :
হেপাটাইটিস বি টিকার মোট ৪ টা ডোজ থাকে।
কখন দিতে হবে :
শিশুর জন্মের পরে যত দ্রুত সম্ভব ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ‘হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন’ এর প্রথম ডোজ দিতে হবে। জন্মের পর ৬ সপ্তাহ হলে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়ে গেলে বাকি দুই ডোজ জন্মের ১০ এবং ১৪ সপ্তাহ হলে দিতে হবে।
বাচ্চার বয়স যখন চার বছর হবে তখন রক্ত পরীক্ষা করে দেখবেন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে বাচ্চার শরীরে কোন এন্টিবডি তৈরী হয়েছে কি না।এন্টিবডি তৈরি হলে আর ফাইনাল ডোজের প্রয়োজন হবে না, কিন্তু এন্টিবডি তৈরি না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ফাইনাল ডোজ দিতে হবে।
কিভাবে দিতে হবে :
হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন শিশুর উরুর সামনের অংশের বাইরের দিকের পেশিতে দেওয়া হয়।
৪.রোটা ভাইরাস টিকা :
রোটা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শিশুদের ডায়েরিয়া রোগ হয়। আর এই ডায়রিয়া শিশুর ইমিউনো সিস্টেমকে দূর্বল করে ফেলে। এর ফলে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন কে সংক্ষেপে ‘আরভিভি’ ও বলা হয়ে থাকে। এই টিকা শিশুদের আপনার বাচ্চাকে প্রাণঘাতী ডায়েরিয়া হওয়া থেকে রোধ করতে সহায়তা করবে।
Dose :
রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিনের মোট ডোজ হল ৩ টি।
কখন দিতে হয় :
শিশুর জন্মের পর প্রথম মাত্রা ৬ সপ্তাহ হলে দিতে হবে। এরপর দ্বিতীয় মাত্রা শিশুর জন্মের ১০ সপ্তাহ হলে দিতে হবে এবং সর্বশেষ মাত্রা জন্মের ১৪ সপ্তাহ হলে দিতে হবে। এই টিকাটি বাচ্চা জন্মের এক বছরের মধ্যেও দেওয়া যেতে পারে।
কিভাবে দিতে হবে :
এই ভ্যাকসিন মুখে খাওয়ানোর মাধ্যমে শিশুকে দেয়া হয়। এক ডোজে পাঁচ ফোঁটা টিকা বা ২.৫ মিলি দেয়া হয়।
৫.ডিপিটি টিকা :
ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, পারটুসিস বা হুপিং কাশি তিনটি মারাত্মক সংক্রমণ রোগ। এই রোগ গুলোর হাত থেকে আপনার বাচ্চাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিষেধক হিসেবে ডিপিটি টিকা দিতে হবে। তাই বাচ্চার জন্য এই ভ্যাকসিন দেয়া অত্যন্ত জরুরি।
Dose :
ডিপিটি ভ্যাকসিনের মোট ডোজ হল ৩ টি।
কখন দিতে হয় :
প্রথম ডোজ শিশুর জন্মের পর ৬ সপ্তাহ হলে দিতে হবে। এরপর দ্বিতীয় মাত্রা শিশুর জন্মের ১০ সপ্তাহ হলে দিতে হবে এবং তৃতীয় মাত্রা জন্মের ১৪ সপ্তাহ হলে দিতে হবে। অথবা টিকাটি বাচ্চা জন্মের এক বছরের মধ্যেও দেওয়া যেতে পারে।
কিভাবে দিতে হবে :
এই ভ্যাকসিন ও হেপাটাইটিস বি টিকার মত উরুর সামনের অংশের বাইরের দিকের পেশিতে দেয়া হয়।
জেনে নিন:শিশুর বয়স এক বৎসর পার না হলে কোন কোন খাবার দেওয়া যাবে না?
৬.পিসিভি টিকা :
‘পিসিভি’ এর পূর্ণ রূপ হল নিউমোক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন। স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি ও হেমোফাইলাস ইনইয়ুযেকি ব্যাকটেরিয়াম এর কারণে নিউমোনিয়া রোগ সৃষ্টি হয়। নিউমোনিয়া ছোট শিশুদের বেশি হয়ে থাকে। পিসিভি টিকা দেয়ার ফলে আপনার শিশু এই রোগ হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
Dose :
পিসিভি ভ্যাকসিনের মোট ডোজ হল ৩ টি।
কখন দিতে হয় :
প্রথম ডোজ শিশুর জন্মের পর ৬ সপ্তাহ হলে দিতে হবে। এরপর দ্বিতীয় মাত্রা শিশুর জন্মের ১৪ সপ্তাহ হলে দিতে হবে। আর লাস্টে যখন শিশুর ৯-১২ মাস হবে তখন একটি বুস্টার ডোজ দিতে হবে।
কিভাবে দিতে হবে :
পিসিভি ভ্যাকসিন উরুর মাঝের অংশের সামনে বাইরের দিকের পেশিতে দিতে হয়।কিন্তু ডিপিটি টিকা যে উরুতে দেয়া হয়েছে তার বিপরীত উরুতে পিসিভি টিকা দিতে হবে।
৭.ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা :
ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি ভাইরাস জনিত সংক্রমণ ব্যাধি। এই রোগ শিশুর শ্বসন তন্ত্রকে আক্রমণ করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে শিশুর হাঁচি, কাশি, তীব্র জ্বর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ইনফ্লুয়েঞ্জা হাত থেকে বাঁচতে অবশ্যই আপনার বাচ্চাকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন দিতে হবে।
Dose :
ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের জন্য দুইটি টিকা আছে। একটি হল টিআইবি এবং অন্যটি হল এএআইভি।
কখন দিতে হয় :
টিআইবি টিকা বাচ্চার জন্মের ৬ মাস বয়সের পর দিতে হবে এবং এএআইভি টিকা বাচ্চার বয়স দুই বছর হলে তারপরে দিতে হবে।
৮. হামের টিকা :
হাম একটি মারাত্মক সংক্রমক রোগ। এই রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অবশ্যই আপনার শিশুকে হামের টিকা দিতে হবে।উন্নত দেশে, হাম এবং রুবেলার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাম এবং রুবেলার টিকা একসাথে দেওয়া হয়।
Dose :
হামের টিকা দুই বার দিতে হয়।
কখন দিতে হয় :
বাচ্চার জন্মের ৯ মাস পূর্ণ হওয়ার পরের থেকে ১২ মাসের মধ্যে তাকে হামের প্রথম টিকা দিতে হবে। ৯ থেকে ১২ মাসের মধ্যে যদি বাচ্চাকে হামের প্রথম টিকা দিতে না পারেন তাহলে পাঁচ বছরের মধ্যে অবশ্য এই টিকা দিতে হবে। আর ১৬ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় টিকা দিতে হবে।
কিভাবে দিতে হবে :
এই ভ্যাকসিন শিশুর ডান হাতের উপরের অংশে সাব-কিউটেনিয়াস ইনজেকশন রূপে দেওয়া দিতে হবে।
৯.চিকেন পক্স টিকা :
চিকেন পক্স বা জল বসন্ত একটি মারাত্নক সংক্রমণ রোগ। জন্মের পরপর যদি এই রোগ হয় এবং সংক্রমণের মাত্রা মারাত্মক হলে এই ভাইরাসের কারণে শিশুর পর্যন্ত ঘটতে পারে।
Dose :
চিকেন পক্স ভ্যাকসিনের ডোজ হল ২ টি।
কখন দিতে হয় :
বাচ্চার জন্মের ১২ মাস পরে এই টিকার প্রথম ডোজ দিতে হবে এবং ৪ থেকে ১২ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে।
১০.টাইফয়েড টিকা :
টাইফয়েড একটি মারাত্নক ঘাতক ব্যাধি। এই রোগ কারণে শিশুর যে কোন অঙ্গ বিকলঙ্গ হয়ে যেতে পারে। এমনকি শিশুর প্রাণহানি পর্যন্ত হতে পারে। সে জন্য সময় মতো বাচ্চাকে এই ভ্যাকসিন দিতে হবে।
কখন দিতে হয় :
আপনার বাচ্চার বয়স দুই বছর হওয়ার পরে বাচ্চাকে এই টিকা দিতে হবে। আর বাচ্চাকে প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর এই টিকা নিতে হবে। কারণ সারা জীবনের জন্য এই টিকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে না।
পড়ুন:
শিশুদের আমাশয় রোগের কারন কি ? প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায়
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর যে উপকারিতা
পরিশেষে,
প্রতিটি শিশুই সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীতে এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা। আর এই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে সবার প্রথমেই শিশুর রোগ ব্যাধির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আপনার শিশুকে সময় মতো ভ্যাকসিন কমপ্লিট করিয়ে নিতে হবে। এতে করে শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সুদৃঢ় হবে। আর কখন কোন টিকা দিবেন উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বিষয় গুলো জেনে নিবেন এবং অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবেন।