আপনার রক্তের গ্লুকোজ লেভেল (Blood Glucose Level) কত হলে সেটা স্বাভাবিক ? আপনার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কতটুকু তা কিভাবে জানবেন ? এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন –
আমাদের সবার রক্তের ভিতরে গ্লুকোজ বা সুগার বিদ্যমান থাকে। এই Glucoseএকটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে ঐ পরিমাণ গ্লুকোজ রক্তে থাকা আমাদের শরীরের জন্য নিরাপদ। তবে কোন কারণে যদি ব্লাডে চিনির পরিমাণ কমা-বাড়া করে তাহলে তা আপনার শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমান সময়ে এখন এই সমস্যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। আপনি যদি রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মান, তা নির্ণয় পদ্ধতি এবং কতটুকু খেলে আপনার শরীরে এই মান বজায় থাকবে প্রভৃতি তথ্য গুলো সম্পর্কে যদি আপনার জানা থাকে তাহলে আপনার পক্ষে এই সমস্যার মোকাবেলা করা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। তবে এই সব তথ্য সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই অজানা রয়েছে যার কারণে আমরা ঠিকমত রক্তে গ্লুকোজের মনিটরিং বা নিয়ন্ত্রণ (Blood Glucose Monitor) করতে পারছি না। এজন্য রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ এবং Glucose পরিমাপ করার পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
Blood Glucose Level কত হলে সেটা স্বাভাবিক ?
রক্তে স্বাভাবিক Glucose লেভেলের চার্ট দুই ভাবে তৈরী করা হয়।
সুস্থ
ব্যক্তি এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
ব্যক্তি।
আপনার
ডায়াবেটিস না থাকলে
* ফাস্টিং বা খাওয়ার আগে আপনার রক্তে Glucose পরিমাণ (Fasting Glucose Level) হবে ৭০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে ৯৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা 3.9-5.5 mmol/L।
* খাওয়ার
২ ঘন্টা পরে আপনার রক্তে
গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা বা পরিমাণ (Normal Glucose Level) ১৪০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার
বা 7.8 mmol/L এর মধ্যে থাকা
উচিত।
* আপনার
HBA1C স্বাভাবিক এর মান ৫.৭% এর কম
থাকা উচিত।
আপনার ডায়াবেটিস থাকলে
* ডায়াবেটিস
থাকলে Fasting বা খাওয়ার আগে
আপনার রক্তে গ্লুকোজর পরিমাণ (Normal Glucose
Level) হবে ৮০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার
থেকে ১৩০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার
বা 4.2-7.2 mmol/L।
* খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে আপনার রক্তে Glucose স্বাভাবিক মাত্রা বা পরিমাণ (Normal Glucose Level) ১৮০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা 10.0 mmol/L এর মধ্যে থাকা উচিত।
* আপনার
HBA1C স্বাভাবিক এর মান ৭.০% এর কম
থাকা উচিত।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপের জন্য আপনি কি ব্যবহার করবেন ?
করোনাকালীন সময়ে রক্তের Glucose লেভেল পরিমাপ করার জন্য অনেকই এখন ঘরোয়া পদ্ধতিকে বেছে নিচ্ছন। আপনিও যদি ঘরে বসে শর্করা বা সুগারের মাত্রা পরিমাপ করতে চান তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে গ্লুকোমিটার (Glucometer) ব্যবহার করতে পারেন।
গ্লুকোমিটার
(Glucometer) ব্যবহার করতে হলে আপনাকে
কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। পদ্ধতি
গুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা
হলো –
হাত
জীবাণুমুক্ত করা :
রক্তের Glucose লেভেল পরীক্ষা করার আগে আপনার দুই হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক দিয়ে হাতের আঙুল পরিষ্কার করে নিতে পারেন। এগুলো করার পর হাত পুরোপুরি শুকানো পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে কারণ হাত ভেজা থাকলে গ্লুকোজের মান সঠিক আসবে না।
স্ট্রিপ
প্রবেশ করানো :
হাত
ভালভাবে শুকানো হয়ে গেলে আপনাকে
গ্লুকোমিটারে ভিতরে একটি পরীক্ষার স্ট্রিপ
প্রবেশ করাতে হবে। বাজারে বিভিন্ন
ধরনের মডেলের গ্লুকোমিটার পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি মডেলের
জন্য আলাদা স্ট্রিপ রয়েছে। এজন্য আপনি যে মিটারটি
ব্যবহার করবেন তার জন্য যে
নির্দিষ্ট স্ট্রিপ রয়েছে সেটিই আপনাকে ব্যবহার করতে হবে। নকল
এবং মেয়াদোত্তীর্ণ স্ট্রিপ ব্যবহার করা যাবে না।
স্ট্রিপের
কৌটা খোলার পর থেকে একটি
নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সেটা আপনি ব্যবহার
করতে পারবেন। আর যখন আপনি
আধুনিক গ্লুকোমিটারে এই স্ট্রিপ প্রবেশ
করাবেন তখন সেটা অটোমেটিক
ভাবে চালু হয়ে যাবে।
স্ট্রিপ প্রবেশ করানো হয়ে গেলে আপনার হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ ফুটা করতে হবে। ফুটা করার জন্য আপনাকে জীবাণুমুক্ত সূচ বা Lancet ব্যবহার করতে হবে। এই Lancet একটি কলমের মধ্যে থাকে । আঙ্গুলের অগ্রভাগে বা ডগায় এই সূচ ফুটানো হয়ে গেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয়ে আসা বড় এক রক্তের ফোঁটাই আপনার Glucose বা চিনির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট।
রক্তের
ফোঁটা স্ট্রিপে স্থাপন করা :
আঙ্গুল
দিয়ে বের হয়ে আসা
এই রক্তের ফোঁটা আপনাকে পরীক্ষার স্ট্রিপের নির্দিষ্ট জায়গায় অর্থাৎ সাদা অংশে স্থাপন
করাতে হবে এবং আঙ্গুলটি
ধরে রাখতে হবে।
কয়েক সেকেন্ড বা বড়জোর এক মিনিট আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আপনার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা গ্লুকোমিটারের ডিজিটাল স্ক্রিনে বা পর্দায় প্রদর্শন করবে। আপনার রেজাল্ট যদি মিলিগ্রামে আসে তাহলে তা ১৮ দিয়ে ভাগ করলে মিলিমোল পেয়ে যাবেন।এভাবে আপনি খুব সহজেই রক্তে Glucose বা সুগারের মাত্রা জেনে নিতে পারেন।
Glucometer ব্যবহার করলে আপনি কিভাবে উপকৃত হতে পারেন ?
গ্লুকোমিটার
ব্যবহার করলে আপনি যেভাবে
উপকৃত হতে পারেন সে
সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো –
* গ্লুকোমিটারের সাহায্যে আপনি ঘরে বসেই তৎক্ষনাৎ রক্তে Glucose বা চিনির পরিমাণ পরিমাপ করতে পারেন। আর এই পদ্ধতিতে রক্ত নেয়ার সময় কোন প্রকার ব্যথা লাগে না অর্থাৎ আপনি খুব সহজেই শরীর থেকে রক্ত নিয়ে চিনির মাত্রা নির্ণয় করতে পারবেন। রক্তের গ্লুকোজ লেভেল নির্ণয় করার জন্য মাত্র এক এক ফোঁটা রক্তই যথেষ্ট।
* রক্তের
শর্করা পরীক্ষার জন্য ঘন ঘন
হাসপাতালে যাওয়ার চাইতে একটি গ্লুকোমিটার কিনে
ব্যবহার করলে আপনার অনেক
সময় সাশ্রয় হবে আর এটা
আকারে ছোট হওয়ায় আপনি
এটিকে ব্যাগে ও বহন করতে
পারবেন।
* আপনার
যদি ডায়াবেটিস থাকে বা বাসায়
কারও ডায়বেটিস আছে, সেক্ষেত্রে আপনার
জন্য গ্লুকোমিটার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি
সরঞ্জাম।
* আপনার
বাড়ির আশেপাশে যদি ল্যাবরেটরি বা
হাসপাতাল না থাকে অথবা
কোথাও বেড়াতে গেলে তখন গ্লুকোমিটারই
আপনার একমাত্র আস্থা।
কি কারণে আপনার গ্লুকোমিটারে রক্তে গ্লুকোজের মান ভুল আসতে পারে ?
আপনার কিছু কমন ভুলের কারণে রক্তে Glucoseবা শর্করার মানে ভুল আসতে পারে। ভুল গুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো –
হাত
না ধুলে :
আপনি
যদি হাত না ধুয়ে
গ্লুকোমিটারে রক্তের শর্করা বা চিনির মাত্রা
পরিমাপ করেন তাহলে আপনার
হাতে ধুলা-ময়লা বা
জীবাণু থাকতে পারে। যার ফলে গ্লুকোজের
মাত্রা পরিমাপে ভুল আসতে পারে।
এজন্য গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপ করার আগে অবশ্যই
আপনাকে ভালভাবে হাত ধুয়ে নিতে
হবে।
খাওয়ার
পরপর মাপলে :
রক্তের গ্লুকোজের মান নির্ণয় করতে
হলে আপনাকে খাওয়ার পর কমপক্ষে দুই
ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। আপনি
যদি খাওয়ার সাথে সাথে অর্থাৎ
তিরিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা
পরেই মাপতে শুরু করেন তাহলে
কিন্তু এতে সঠিক রেজাল্ট
পাবেন না।
মেয়াদোত্তীর্ণ
স্ট্রিপ ব্যবহারের কারণে :
গ্লুকোমিটারটি
আপনি যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ
বা নিয়মিত পরিষ্কার করে না রাখেন
তাহলে রেজাল্টে ভুল আসতে পারে। এ
ছাড়াও আপনি যদি মেয়াদোত্তীর্ণ
বা অনেকদিনের পুরানো স্ট্রিপ ব্যবহারের করেন কিংবা ব্যবহৃত
সুই এবং স্ট্রিপ পুনরায়
ব্যবহার করেন তাহলে ও
কিন্তু ফলাফলে ভুল আসতে পারে।
চেপে
রক্ত বের করলে :
আপনি যদি কোন সময় চেপে রক্ত বের করেন তাহলে আপনার রক্তের চেয়ে ইন্টারস্টিশল ফ্লুইড (Interstitial fluid) বেশি বেরিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার রক্তের Glucoseপরীক্ষার রেজাল্টে ভিন্নতা আসতে পারে।
আঙ্গুলের
ডগায় ফুটা না করলে
:
ব্লাড
নেওয়ার সময় আপনাকে আঙ্গুলের
ডগায় বা শেষ মাথায়
ফোঁটা করতে হবে। অন্য
জায়গায় ফোঁটা করলে আপনার ব্যথা
লাগতে পারে। এর ফলে রেজাল্টে
গড়মিল হতে পারে।
অবশেষে আমরা বলতে পারি যে,
রক্তের
চিনির মাত্রা বা Blood Glucose Level এর স্বাভাবিক মানের
ভিতরে রাখতে পারলে আমরা অনেক জটিল
রোগ হওয়ার হাত থেকে রেহাই
পেতে পারি। এজন্য আপনাকে সব সময় রক্তের
গ্লুকোজ লেভেল মনিটরিং বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে
রাখতে হবে। আর গ্লুকোজ
লেভেল মনিটরিং করার জন্য অবশ্যই
আপনাকে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করতে হবে যেমন
: মানসিক দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে, গতিশীল বা
কর্মক্ষম রাখতে হবে। তা না
হলে আপনার শরীরে এর প্রভাব বেড়ে
গেলে বা কমে গেলে
পরবর্তীতে এর থেকে আপনার
শরীরে নানা ধরনের জটিলতা
দেখা দিতে পারে যা
আপনার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে মারাত্মক বাঁধার
কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তাই আপনি যদি ব্লাড
গ্লুকোজ লেভেল বা রক্তে শর্করার
মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চান তাহলে অবশ্যই
আপনাকে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং অবশ্যই
ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।