অনিয়ন্ত্রিত
ডায়াবেটিস
হলে
আপনার শরীরের কোন কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি হতে পারে ? এ
সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন –
বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস এখন আমাদের সবার কাছে একটি অতি পরিচিত রোগের নাম। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই এখন ডায়াবেটিসের রোগী দেখতে পাওয়া যায় এবং প্রতিনিয়ত এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞ দের মতামত অনুসারে, জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই মূলত এই রোগ হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ডায়াবেটিসে আক্রাম্ত হওয়ার পরেও তারা এই রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পালন করে না সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যেতে পারে। আর এই ডায়াবেটিস থেকে পরবর্তীতে আপনার শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এই রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অনেকেরই অজানা রয়েছে যার কারণে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এজন্য Uncontrolled Diabetes এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
Uncontrolled Diabetes শরীরের যে সব অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতিহতে পারে ?
হৃদপিণ্ড (Heart) :
আপনি
যদি দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের
সমস্যায় ভুগেন তাহলে এটি আপনার হার্ট
বা হৃদপিণ্ডের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর
প্রভাব ফেলতে পারে। হার্টের সাথে শরীরের অংশগুলো
অতিপ্রত ভাবে জড়িত রয়েছে। এ ডায়াবেটিসের কারণে আপনার হার্টে সমস্যা হলে এর সাথে
শরীরের যে অন্যান্য রক্তনালি
গুলো জড়িত রয়েছে তার
ভেতরে প্রদাহ বা ব্যথা হতে
পারে। এই ব্যথা থেকে
পরবর্তীতে আপনার হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর অথবা অন্যান্য হার্টের
রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
মস্তিষ্ক (Brain) :
ডায়াবেটিস আপনার ব্রেন বা মস্তিষ্কের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।এর কারণে আপনার মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে যার ফলে আপনার ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর কারণে আপনার ব্রেনে টিউমার, ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
পড়ুন :ব্রেন ক্যান্সার (Brain Cancer) কী ? ব্রেন ক্যান্সার হলে ,দেহে কোন ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় ?
ব্রেন স্ট্রোক( Brain Stroke) কী কারণে হয়? ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ বা উপসর্গ কি ক?
কিডনি (Kidney) :
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সমস্যা যদি দীর্ঘদিন ধরে আপনার শরীরে থাকে তাহলে এটি আপনার রেনাল বা কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। শরীরে ডায়াবেটিসের প্রভাব বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে প্রথমে আপনার কিডনি থেকে প্রোটিন বের হতে শুরু করে। এর ফলে আপনার প্রস্রাব করার সময় ফেনা উঠতে পারে।
পরবর্তীতে ডায়াবেটিস প্রভাব যদি আরও বেড়ে যায় তাহলে আপনার ক্রোনিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে এবং আপনি যদি চিকিৎসা না করান তাহলে আপনার কিডনি ফেলিওর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
স্নায়ুতন্ত্র (Nerve System) :
আপনার শরীরের নার্ভ সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রের উপর ও ডায়াবেটিস ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হলে এক্ষেত্রে আপনার স্নায়ুতন্ত্রতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয় না। আর এই সমস্যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি।
এর ফলে ধীরে ধীরে
আপনার স্নায়ুতন্ত্র তার নিজের কার্যক্ষমতা
হারাতে শুরু করে। এই
সমস্যা শুরু মূলত পা
থেকে হয়। এর ফলে
পায়ের শক্তি হারাতে থাকে। নার্ভের সমস্যার কারণে প্রায় সময় আপনার পা
ঝিনঝিন করা হতে পারে।
পায়ের রোগ (Leg Disease) :
দীর্ঘদিন
ধরে আপনি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগলে এটি আপনার পায়ের
কার্য ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
এর ফলে আপনার পায়ে
রক্ত সঞ্চালন ঠিকমত হয় না।
আর এই দূর্বল রক্ত
প্রবাহের কারেণ আপনার পায়ের ঘা বা সংক্রমণ
থেকে আরোগ্য লাভ করা অনেক
কঠিন হয়ে যেতে পারে।
যাকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের
ভাষায় আমরা ডায়াবেটিক ফুট
বলে থাকি। আর এই সমস্যা
যদি আপনার পায়ে দেখা দেয়
তাহলে আপনার সংক্রমিত বা আক্রান্ত
পা কেটে ও ফেলতে
হতে পারে।
চোখ (Eye) :
আপনার
শরীরে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণহীনতা দেখা দেয়ার ফলে
এটি আপনার দুটি চোখকেই ক্ষতি
গ্রস্থ করতে পারে। আপনার
চোখে যদি ডায়াবেটিস আক্রমণ
করে তাহলে সেটিকে বলা হয় ডায়াবেটিস
আই ডিজিজ বা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।
চোখের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হল রেটিনা। আপনার চোখে ডায়াবেটিস আক্রমণ করলে ও চোখের এই অংশটি একবারে নষ্ট হয় না। এটি আস্তে আস্তে নষ্ট হয় এবং এর কারণে আপনি ধীরে ধীরে অন্ধত্বের দিকে ধাবিত হতে পারেন। রেটিনা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আপনার কার্য ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়া ও Uncontrolled Diabetes এর কারণে আপনার চোখে ছানি পড়া, ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়ার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দাঁত (Teeth) :
আপনি যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারেন তাহলে এর প্রভাব আপনার দাঁতের উপর ও পড়তে পারে। ডায়াবেটিস দাঁতে ছড়িয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি ডেন্টাল ক্যারিজ। এই রোগ হলে আপনার দাঁত ক্ষয় হয়ে যেতে পারে এবং দাঁতের গোড়ার দিকে ইনফেকশন হতে পারে। চিকিৎসা না করালে এই ইনফেকশনের কারণে ক্রমাগত ভাবে আপনার একটার পর একটা দাঁত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি দাঁত ফেলে ও দিতে হতে পারে।Uncontrolled Diabetesএর কারণে অনেক সময় আপনার মুখে ইনফেকশন হতে পারে।
ডায়াাবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে
নিম্নোক্ত পদ্ধতি গুলো অবলম্বন করতে
হবে তাহলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা আপনার জন্য
অনেক সহজ হয়ে যাবে।
পদ্ধতি গুলো হল –
আপনাকে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবার
প্রথমেই জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করা দরকার। রোগ-ব্যাথি এবং নিজের শরীরকে
ভাল রাখার ব্যাপারে সব সময় সচেতন
থাকতে হবে। অসুখ-বিসুখ
দেখা দেয়ার সাথে সাথে হেলা-ফেলা না করে
অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
দৈনন্দিন
ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা
:
নিয়মিত
যদি আপনি শরীরচর্চা এবং
ব্যায়াম করেন তাহলে আপনার
শরীর থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ
বা চিনি ঘামের মাধ্যমে
বেড়িয়ে যাবে। নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে আপনার
রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা ও স্বাভাবিক থাকবে
এবং হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি
ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি
হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলক ভাবে অনেক কমে
যাবে। এর ফলে আপনার
শরীর চাঙ্গা থাকবে এবং কাজ করার
শক্তি আরও বেড়ে যাবে।
তাই মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য
প্রতিদিন অন্তত আপনার ৩০ মিনিট শারীরিক
ব্যায়াম করা উচিত।
প্রয়োজনে পড়ুন :নিয়মিত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস থাকবে নিয়ন্ত্রণে
মিষ্টি
জাতীয় খাবার পরিহার করা :
ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে
মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না বা
পরিমাণে খুব কম খেতে
হবে। কারণ এসব খাবারে
প্রচুর পরিমাণ শর্করা ও চিনি থাকে
যার ফলে এই শর্করা
ও চিনি জাতীয় খাবার
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে
যা আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে
পারে।
অতিরিক্ত
তেল যুক্ত খাবার পরিহার করা :
আপনার
ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অতিরিক্ত
তেল যুক্ত খাবার পরিহার করা অত্যাবশ্যক। কারণ
অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার
আপনার অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি করার সাথে রক্তে
গ্লুকোজের পরিমাণও বৃদ্ধি করতে পারে তাই
আপনাকে এ সব তেলে
ভাজা খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
অ্যালকোহল
যুক্ত খাবার ত্যাগ করা :
আপনাকে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সব ধরনের
অ্যালকোহল জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে
হবে কারণ এসব পানীয়
বা অ্যালকোহল জাতীয় খাবারের মধ্যে উচ্চ মাত্রার গ্লুকোজ
মিশানো থাকে। আর এগুলো সরাসরি
আপনার রক্তে পৌছে গিয়ে ইনসুলিন
মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ফাস্ট
ফুড খাওয়া বন্ধ করা :
বাজারে
বিভিন্ন রকমের ফলের জুস পাওয়া
যায় এসব খাওয়া থেকে
আপনাকে বিরত থাকতে হবে।
কারণ এসব খাবারে চিনি
মিশানো থাকে এবং যা
আপনার ডায়াবেটিসের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
সুষম
খাবার গ্রহণ করা :
আপনার
ডায়াবেটিসের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য
সুষম খাবার গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আপনি
যদি সুষম খাবার বা
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী খাবার যেমন : বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার,
সবুজ শাক-সবজি, প্রয়োজনীয়
আমিষ ইত্যাদি বেশি করে খান
তাহলে আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করতে হবে।
এর ফলে আপনার কাজ
করার শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে।
দৈনন্দিন কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে রোগ-বালাই কম হবে এবং
আপনি সহজ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
করতে পারবেন।
পরিশেষে
আমরা বলতে পারি যে,
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস একটি জটিল ব্যাধি এবং এর সাথে নীরব ঘাতক ও বলা যেতে পারে। কারণ এটি কীভাবে যে আপনার শরীরের ক্ষতি করবে তা আপনি নিজে ও বুঝতে পারবেন না। অতএব আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে অবশ্যই সেটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। তা না হলে আপনার শরীরে এর প্রভাব বেড়ে গেলে পরবর্তীতে এর থেকে উপরিউক্ত জটিল রোগ গুলো সৃষ্টি হতে পারে যা আপনার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে মারাত্মক বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু আপনি যদি প্রাথমিক অবস্থায় এসব রোগের চিকিৎসা করান এবং আপনার ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের ভিতরে রাখতে পারেন তাহলে আপনি দ্রুতই এই সব রোগ থেকে সেরে উঠে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। তাই আপনি যদি Uncontrolled Diabetesক্ষতিকর প্রভাবগুলো হওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।