গর্ভপাত (Miscarriage) কেন হয় ?জেনে নিন ,গর্ভপাতের লক্ষণ সমূহ কি কি ?

গর্ভপাত (Miscarriage) কি এবং কেন হয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন -

                               গর্ভপাত  কেন হয়  গর্ভপাতের লক্ষণ সমূহ কি কি

গর্ভপাত প্রতিটি নারীর জীবনে একটি জটিল সমস্যা বা একটি দূর্ঘটনা বলা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বে এখন আমাদের মধ্যে অধিকাংশ নারীরা গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত এই সমস্যায় ভুক্তভোগী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মধ্যে এমন অনেক নারী রয়েছেন যারা গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের সর্তকতা বা লক্ষ্মণগুলো সম্পর্কে ঠিকমত জানেন না। এর ফলে আপনার গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে। গর্ভপাতের ফলে আপনার শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা যায়। এজন্য গর্ভপাত সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।

গর্ভপাত (Miscarriage) আসলে কী ?

গর্ভপাতকে ইংরেজিতে আমরা বলি Miscarriage একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অনেক সময় আমরা অ্যাবরশন (Abortion) বলে  থাকি। একজন নারীর গর্ভধারণের ১৪-২৮ সপ্তাহের মধ্যে যদি তার গর্ভে থাকা শিশুটির মৃত্যু ঘটে তখন এই অবস্থাকে গর্ভপাত বা Miscarriage বলা হয়ে থাকে সময় প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হতে পারে। সাধারণত অধিকাংশ নারীরাই গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এই দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে থাকে।

গর্ভপাত (Miscarriage) কয় ধরনের হয়ে থাকে ?

সাধারণত নারীদের গর্ভাবস্থায় পাঁচ ধরনের গর্ভপাত বা Miscarriage দেখা দিতে পারে। সে গুলো হল

  •   Complete Miscarriage (সম্পূর্ণ গর্ভপাত)
  •   Incomplete Miscarriage (অসম্পূর্ণ গর্ভপাত)
  •   Missed Miscarriage (মিসড মিসক্যারেজ)
  •   Threatened Miscarriage (গর্ভপাতের আশঙ্কা)
  •   Inevitable Miscarriage (অনিবার্য গর্ভপাত)

উপরিউক্ত গর্ভপাতগুলোর ভিতর থেকে Inevitable Miscarriage এর সমস্যায় ভুগা নারীদের গর্ভপাতের সময়ে তীব্র রক্তপাত হয়ে থাকে। 

কী কারণে আপনার গর্ভপাত (Miscarriage) হতে পারে ?

আপনার গর্ভপাত (Miscarriage) হওয়ার পেছনে রয়েছে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ থাকতে পারে। কারণগুলো সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত জেনে নিন :

ক্রোমোজোমাল ত্রুটি :

ক্রোমোজোমাল ত্রুটি বা পরিবর্তনের কারণে আপনার গর্ভপাত ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তার মানে হল শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর গঠনে যদি কোন পরিবর্তন ঘটে তাহলে আপনার গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ইনফেকশন হলে :

আপনার জরায়ুতে ইনফেকশন বা ঘা থাকার কারণে গর্ভপাত হতে পারে।

জরায়ু মুখের সমস্যা থাকলে :

আপনার জরায়ুর মুখ যদি জরায়ুর ভিতরে ভ্রূণকে ঠিকমত ধরে রাখতে না পারে তাহলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পেটে আঘাত পেলে :

গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন সময়ে আপনি যদি পেটে আঘাত পান বা পড়ে যান তাহলে আপনার গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

বয়স বৃদ্ধি পেলে :

আপনি যদি ৩৫ এর চেয়েও বেশি বয়সে গর্ভবতী হন তখন আপনার গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে আপনার বাচ্চা ধারণ করার ক্ষমতা কমে যেতে থাকে।

ধূমপান করলে :

গর্ভাবস্থায় ধূমপান করার ফলে আপনার ভ্রূণের মৃত্যু ঘটতে পারে সিগারেটের ভিতরে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে। যার ফলে আপনার গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্থুলতার কারণে :

আপনি যদি স্থুলতায় ভুগে থাকেন অথবা আপনার শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যায় তাহলে আপনার গর্ভপাত ঘটার চরম সম্ভাবনা রয়েছে।  

ডায়াবেটিস থাকলে :

আপনি যদি গর্ভাবস্থার আগে থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকেন এবং দীর্ঘদিন ধরে যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে আপনার গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে :

আপনার আগে থেকে যদি থাইরয়েডের সমস্যা থাকে তাহলে আপনার গর্ভপাত ঘটতে পারে।

হরমোনের সমস্যা থাকলে :

আপনার যদি আগে থেকে হরমোনের কোন সমস্যা থাকে তাহলে আপনার গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

 অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করলে :

আপনি যদি গর্ভাবস্থায় মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য বেশি খান তাহলে এর ভিতরে থাকা উচ্চ মাত্রার অ্যালকোহল আপনার জরায়ুতে থাকা ভ্রূণের বিকাশে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যার ফলে আপনার গর্ভপাতের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

গর্ভপাত (Miscarriage) হলে যে সব লক্ষণ দেখা যায় ?

সাধারণত গর্ভপাত বা Miscarriage হলে আপনার শরীরে নিম্নলিখিত লক্ষ্মণগুলো দেখা দিয়ে থাকে। লক্ষ্মণ গুলো দেখা দিলে আপনাকে সতর্ক হয়ে যেতে হবে।

লক্ষ্মণ গুলো হল

পেটে ব্যাথা করা :

গর্ভপাত হওয়ার আগে আপনার  তলপেটের চারপাশ ঘিরে অসম্ভব যন্ত্রণা বা ব্যাথা করতে পারে। ধীরে ধীরে আপনার এই ব্যাথার প্রবণতা প্রবল আকার ধারণ করতে পারে। 

অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া :

আপনার গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে যদি বেশি রক্তপাত হয় তাহলে এটিকে গর্ভপাতের প্রধান লক্ষ্মণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

পেশিতে ব্যথা করা :

সাধারণত গর্ভপাত হওয়ার আগে আপনার কোমরের ব্যথা বা পিঠের ব্যথা হতে পারে এবং ধীরে ধীরে আপনার এই ব্যথার প্রবণতা বাড়তে থাকে।

পানি ভাঙ্গা :

গর্ভপাত ঘটার আগে হঠাৎ করে আপনার যোনীপথ দিয়ে প্রচুর পরিমাণ পানি বা সলিড টিস্যু  আপনার শরীরের থেকে বের হয়ে যেতে পারে।

যোনীপথ দিয়ে মিউকাস যাওয়া :

গর্ভপাত হওয়ার পূর্বে আপনার যোনীপথ দিয়ে সাদা-গোলাপি বর্ণের মিউকাস জাতীয় পদার্থ বের হতে থাকে।

খিঁচুনি দেখা দেয়া :

অনেক সময় গর্ভপাতের আগে আপনার তীব্র ব্যথার সাথে সাথে খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।

বাদামী বর্ণের স্রাব :

গর্ভপাত হওয়ার আগে আপনার যোনীপথ দিয়ে বাদামী বর্ণের স্রাব নিঃসৃত হতে পারে। 

অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা :

গর্ভপাতের আগে আপনার শরীর অনেক দূর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং সময় আপনার অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হয়ে থাকতে পারে।

হঠাৎ করে ওজন হ্রাস পাওয়া :

আপনার জরায়ুতে গর্ভপাতের প্রভাব বেড়ে গেলে আপনার দেহের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হ্রাস পেতে পারে।

গর্ভাবস্থার লক্ষ্মণ গুলো হ্রাস পাওয়া :

আপনার গর্ভপাতের প্রবণতা যদি বেড়ে যায় তাহলে আপনার স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার লক্ষ্মণ গুলো ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পারে।

বাচ্চার হৃৎস্পন্দন শুনতে না পেলে :

গর্ভাবস্থার যদি আপনার শিশুর হৃৎস্পন্দন শুনতে না পান তাহলে এটিও আপনার গর্ভপাতের একটি লক্ষ্মণ। 

আরও জানুন :

গর্ভাবস্থায় হাত পা ফুলে গেলে বা পানি জমলে কি করবেন ? 

গর্ভপাত বা Miscarriage এড়াতে যে সব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ? 

 অনিয়মিত ঋতুস্রাব( Irregular Period) নিয়মিত করার কিছু সেরা ঘরোয়া টিপস

গর্ভপাত হলে কোন ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয় ?

আপনার গর্ভে থাকা ভ্রূণের অবস্থান ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসক নিম্ন লিখিত পরীক্ষা-নীরিক্ষা গুলো করে থাকেন। পরীক্ষা-নীরিক্ষা গুলো হল

* Pelvic Examination (পেলভিক এক্সামিনেশন)

* Lab Test (ল্যাব পরীক্ষা)

* TVS (টিভিএস)

* USG of Pregnancy Profile (ইউএসজি অফ প্রেগন্যান্সি প্রোফাইল)

উপরিউক্ত পরীক্ষা-নীরিক্ষাগুলো করার আগে অবশ্যই আপনাকে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

গর্ভপাত হলে কী উপায়ে প্রতিকার করবেন  ?

গর্ভপাতের লক্ষ্মণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই আপনাকে সবার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এরপর চিকিৎসক আপনার গর্ভে ভ্রূণের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজন বোধে নিচের পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে থাকেন। পদ্ধতি গুলো হল

রক্তক্ষরণ বন্ধ করা :

গর্ভপাতের প্রথম দুই সপ্তাহের পরে যদি আপনার রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয় তাহলে চিকিৎসক আপনাকে মেডিকেশন করার পরামর্শ দিতে পারেন। এর ফলে আপনার রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

ইনফেকশন প্রতিরোধ করা :

এর জন্য চিকিৎসক আপনার শরীরে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ প্রয়োগ করাতে পারেন।

ডি অ্যান্ড সি বা সার্জারি :

এর মাধ্যমে চিকিৎসক আপনার জরায়ু থেকে অপ্রয়োজনীয় টিস্যুগুলো অপসারণ করে থাকেন।

কীভাবে গর্ভপাত প্রতিরোধ করবেন ?

গর্ভপাত বা Miscarriage এর থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এবং সেগুলো ঠিক মত পালন করতে হবে। বিষয়গুলো হল

জীবনযাত্রার পরিবর্তন করা :

আপনাকে গর্ভপাত প্রতিরোধ করার জন্য সবার আগেই জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করা দরকার। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে সময় আপনাকে রোগ-ব্যাথি সম্পর্কে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়ার সাথে সাথে হেলা-ফেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

মানসিক অবসাদ দূর করা :

গর্ভপাত প্রতিরোধ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই মানসিক চাপ মুক্ত থাকতে হবে। এর ফলে আপনার জরায়ুতে ভ্রূণের বিকাশ স্বাভাবিক থাকবে এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি কমে যাবে।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা :

গর্ভপাত প্রতিরোধ করার জন্য আপনার শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য আপনাকে অতিরিক্ত তেল-চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

পূর্ণ বিশ্রাম করা :

গর্ভপাত প্রতিরোধ করার জন্য আপনাকে নিয়মিত বিশ্রাম করতে হবে। গর্ভাবস্থায় কোন প্রকার ভারী কাজ বা বেশি উঁচু-নিচু হওয়া কাজ করা থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে। 

বেশি করে পানি পান করা :

গর্ভপাত প্রতিরোধ করার জন্য আপনাকে বেশি বেশি করে পানি পান করতে হবে। এর ফলে আপনার শরীরে পানির চাহিদা ঠিক থাকে এবং ভ্রূণের বিকাশ ঠিক মত হবে। যার ফলে আপনার গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যেতে পারে। 

ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করা :

গর্ভপাত বা Miscarriage প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই আপনাকে ধূমপান এবং মদ্যপান করা বন্ধ করে দিতে হবে। এর ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থগুলো আপনার জরায়ু বা ইউটেরাসের ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না এবং আপনার ভ্রূণের বিকাশ স্বাভাবিক থাকবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা :

আপনার গর্ভাবস্থার আগে থেকে ডায়াবেটিস থাকলে এবং গর্ভপাত প্রতিরোধ হলে আপনাকে অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই জন্য আপনাকে সব ধরণের মিষ্টিজাতীয় খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।

 সুষম খাবার খাওয়া :

আপনাকে গর্ভপাতের হাত থেকে নিজেকে এবং শিশুকে বাঁচানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে গর্ভপাত প্রতিরোধী খাবার যেমন: সবুজ শাক-সবজী, মাছের তেল, বাদাম  প্রভৃতি খেতে হবে। এগুলো আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় মিনারেল এর চাহিদা পূরণে সহায়তা করে।

উপসংহার, 

আমরা জানি গর্ভপাত প্রতিটি নারীর জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা বা একটি স্বপ্ন ভঙ্গ বলা যেতে পারে। তবে সময় হতাশ না হয়ে আপনাকে এর লক্ষ্মণ গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং লক্ষ্মণ প্রকাশের সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে তাহলে আপনি দ্রুতই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন এবং পরবর্তীতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সুস্থভাবে সন্তান জন্ম দিতে পারেন। তাই আপনি যদি গর্ভপাত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই উপরিউক্ত বিষয়গুলোর লক্ষ্য রাখতে হবে এবং সেগুলো মেনে চলতে হবে এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। 

 

 

Post a Comment

Previous Next