বর্তমান সময়ে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই হার্ট অ্যাটাক রোগ সম্পর্কে জানেন। হার্ট অ্যাটাক হল একটি জটিল ব্যাধি। এটি মূলত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে হয়ে থাকে। হার্ট অ্যাটাকের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক এ আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। তাই আমাদের হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
এখানে আরও যা যা পাচ্ছেন........
- হার্ট অ্যাটাককে নীরব ঘাতক বলা হয় কেন?
- কী কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে?
- কী কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে?
- কী কী কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে?
- হার্ট অ্যাটাক হওয়ার লক্ষণগুলো কী কী?
- ঔষধ ছাড়া কী উপায় অবলম্বন করলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা যায়?
হার্ট অ্যাটাক আসলে কী ?
হার্ট এর ভিতরে করোনারী ধমনী রয়েছে। এর ভিতর দিয়ে রক্ত চলাচল করে। এই করোনারী ধমনীতে যখন চর্বি জমে হার্ট ব্লক হয়ে যায় এবং রক্ত জমাট বেঁধে থাকে তখন এই ধমনীতে রক্তনালীর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে হার্ট এর মাংসপেশিতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হয়ে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই পরিবর্তনকে Myocardial Infarction বা হার্ট অ্যাটাক বলা হয়ে থাকে।
হার্ট অ্যাটাক কাদের হয়ে থাকে ?
হার্ট অ্যাটাক নারী-পুরুষ উভয়েরই হয়ে থাকে। তবে পরুষের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। এই রোগের কোন নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। তবে বর্তমান সময়ে মধ্যবয়স্ক অর্থাৎ ৩০-৫০ বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এর অন্যতম কারণ হল জীবনযাত্রায় পরিবর্তন।
পড়ুন :Insomnia বা নিদ্রাহীনতা আপনার শরীরে মারাত্নক প্রভাব ফেলতে পারে
হার্ট অ্যাটাককে নীরব ঘাতক বলা হয় কেন ?
কী কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে ?
ধূমপান এবং মদ্যপান :
ধূমপান এবং মদ্যপান করলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। দীর্ঘদিন ধূমপান করলে যে ধোঁয়া সৃষ্টি হয় এই ধোঁয়া নাকের ভিতর দিয়ে শরীরে প্রবেশের পর হার্টে ঢুকে জমা হয় পরে হার্টকে ব্লক করে দেয়। এর ফলে হার্টে আর রক্ত চলাচল করতে পারে না। তখন হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
মদ্যপান করলে ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ মদে উচ্চ মাত্রার অ্যালকোহল মিশ্রিত থাকে। দীর্ঘদিন ধরে মদ্যপান করার ফলে এই অ্যলকোহল হার্ট এ জমা হয়ে পরে হার্ট ব্লক সৃষ্টি করে। এরপর যখন হার্ট আর রক্ত পাম্প করতে পারে না তখন হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ (High blood pressure ):
যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ এর ফলে রক্তনালিতে রক্তচাপ বেড়ে যায়। আর এই চাপ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ধীরে ধীরে হার্ট এর রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস ( Diabetes):
ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস এর মাত্রা যদি বেশি থাকে তাহলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
পড়ুন :ডায়াবেটিস হলে করণীয় কি? ডায়াবেটিস এবং তার প্রতিরোধ কিভাবে করবেন?
শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাওয়া :
শরীরে ওজন বৃদ্ধি পেলে রক্ত ঠিকমত চলাচল করতে পারে না। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
দেখে নিন :
ওজন বাড়ার ফলে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে ? কীভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন
উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল গ্রহণ :
যারা উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খেয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। কারণ এই কোলেস্টেরল দ্রুত হার্টে জমা হয়ে হার্ট ব্লক করে দেয়। এর ফলে হার্টে আর রটিস :ক্ত চলাচল করতে পারে না। তখন হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার লক্ষণগুলো কী কী?
প্রচন্ড বুকে ব্যাথা করা :
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আগে সাধারণত বুকের মাঝখানে প্রচন্ড ব্যাথা করতে থাকে। ধীরে ধীরে এই ব্যাথা ঘাড়ের পেছন দিক হয়ে পুরো হাতে ছড়িয়ে পড়ে।
শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম ঝরা :
হার্ট হওয়ার আগে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম ঝরতে থাকে। এটা সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। এই ঘামের সাথে তাদের বুক ধরফড় করতে থাকে এবং শরীর অনেক দূর্বল হয়ে পড়ে।
দীর্ঘদিন ধরে কাশি থাকা:
দীর্ঘদিন ধরে কাশির সমস্যা থাকলে এবং নিয়মিত কাশির সাথে যদি রক্ত পড়তে থাকে তাহলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শ্বাসকষ্ট হওয়া এবং দম ফুরিয়ে যাওয়া :
সাধারণত হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আগে যদি কোন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকে তার প্রচুর শ্বাসকষ্ট হয় এবং দম ফুরিয়ে যেতে পারে।
অজ্ঞান হয়ে পড়া :
সাধারণত কোন ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হলে সেই ব্যক্তি অজ্ঞান বা অচেতন হয়ে পড়েন। এ রকম ঘটনা ঘটলে অবশ্যই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
শরীর দূর্বল হয়ে পড়া :
সাধারণত ব্যক্তি অল্প কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠেন। শরীরে প্রচুর ক্লান্তি অনুভব হয়। এ রকম হলে ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মাথা ব্যাথা করা :
প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করা ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার একটি পূর্ব লক্ষণ। ব্যাথা হওয়ার পর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পালস রেট ওঠা-নামা করা :
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আগে সাধারণত ব্যাক্তির পালস রেট ওঠা-নামা করতে থাকে। অতিরিক্ত টেনশনের কারণে এ রকমটি হয়ে থাকে।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিকারের উপায়গুলো কী কী?
হার্ট অ্যাটাক হলে সাধারণত চিকিৎসকরা নিচের পদ্ধতি অবলম্বন করে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
* ECG (ইসিজি)
* Angioplasty (এনজিওপ্লাসটি)
* Bypass (বাইপাস)
ECG:
সাধারণত রোগীর হার্ট এর অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা ইসিজি করে থাকেন। এ অবস্থায় তারা সাধারণত রোগীকে অক্সিজেন ও স্যালাইন দিয়ে থাকেন। এ রকম অবস্থায় সাধারণত ঔষধের মাধ্যমে এই রোগের প্রতিকার করা যায়।
Angioplasty:
চিকিৎসকরা এনজিওপ্লাসটির মাধ্যমে হার্টে কি পরিমাণ ব্লক হয়েছে তা নির্ণয় করে থাকেন। সাধারণত ওষুধে যদি ঠিকমত কাজ না করে তখন চিকিৎসকরা এনজিওপ্লাসটি করে থাকেন। এনজিওপ্লাসটিতে চিকিৎসকরা রোগীর হার্ট এ Micro ring পরিয়ে থাকেন।
Bypass:
বাইপাসের আর এক নাম হল ওপেন হার্ট সার্জারি। হার্ট এর অবস্থা খুব বেশি খারাপ হলে চিকিৎসকরা বাইপাস বা ওপেন হার্ট সার্জারি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
হার্ট অ্যাটাক থেকে বাচার উপায় ?
সাধারণত নিম্নলিখিত নিয়মগুলো ঠিকমত অনুসরণ করলে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে।
মানসিক অবসাদ দূর করা :
হার্ট অ্যাটাক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সবার প্রথমে মানসিক অবসাদ বা অতিরিক্ত টেনশন দূর করতে হবে। কারণ অতিরিক্ত টেনশনই সব জটিল রোগের মূল কারণ। এজন্য সুস্থ থাকতে হলে অবশ্যই টেনশনমুক্ত থাকতে হবে।
পড়ুন :
যে সব বিষয় অবলম্বন করলে আপনি মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারেন ?
নিদ্রাহীনতা আপনার শরীরে মারাত্নক প্রভাব ফেলতে পারে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা :
ডায়াবেটিস রোগীর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার প্রবণতা বেশি। এজন্য হার্ট অ্যাটাক থেকে মুক্তি পেতে হলে ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মিষ্টিজাতীয় খাবার কম করে খেতে হবে।
নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করা :
বেশিরভাগ মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে কায়িক পরিশ্রম না করার কারণে। আমরা দিনের অধিকাংশ সময় পার করি টিভি-মোবাইল দেখে। নিয়মিত পরিশ্রম না করার কারণে আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ গুলো অকেজো হয়ে যায়। এর ফলে শরীরের ওজন ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে অবশ্যই আমাদেরকে কায়িক পরিশ্রম বা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। এতে আমাদের শরীরে রক্ত চলাচল ঠিক থাকবে।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা :
উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এজন্য তাদেরকে সব সময় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে।
ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা :
ধূমপানীয় ও মদ্যপানীয় ব্যাক্তির হার্টে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে না। অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান করার ফলে তার হার্টকে ব্লক করে দেয়। এজন্য সুস্থ থাকতে হলে এবং হার্ট অ্যাটাক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অবশ্যই তাকে ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে।
উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল পরিহার করা :
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে গেলে কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার বা যেসব খাবারে অতিরিক্ত তেল-চর্বি থাকে ঐসব খাবার খাওয়া পরিহার করতে হবে। কারণ এই তেল-চর্বি হার্টের ভিতর জমে হার্টে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। এজন্য উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খাওয়া পরিহার করতে হবে বা পরিমাণে কম খেতে হবে।
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা :
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হল শরীরের ওজন অধিক বৃদ্ধি পাওয়া। শরীর বেশি ভারী হয়ে গেলে রক্ত চলাচল করতে সমস্যা হয়। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য শরীরের ওজন সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূল বেশি করে খাওয়া :
সবুজ শাক-সবজি এবং এর মধ্যে আঁশযুক্ত খাবার হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ প্রতিরোধে অনেক উপকারী। এজন্য হার্টের রোগীকে বেশি করে সবুজ শাক-সবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।তাজা ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। এগুলো রক্ত চলাচলে সাহায্য করে।
পরিশেষে বলা যায় যে,
হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ একটি মারাত্মক ব্যাধি। এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে এবং উপরিউক্ত নিয়মগুলো অনুসরণ করলে এই রোগের মাত্রা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন। তবে নিয়মগুলো যদি ঠিকমত অনুসরণ না করা হয় বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে হার্ট অ্যাটাক-এ আক্রান্ত হয়ে রোগীর অকাল মৃত্যুর ও হতে পারে।